শ্রবণ হানি বা শোনার ক্ষমতার হ্রাস এমন একটি সমস্যা যা মানুষের দৈনন্দিন জীবনে গভীর প্রভাব ফেলতে পারে। এটি একটি সাধারণ সমস্যা, যা পৃথিবীজুড়ে লক্ষ লক্ষ মানুষকে প্রভাবিত করে। শুরুর দিকে এটি সাধারণত লক্ষণীয় না হলেও, সময়ের সাথে সাথে শ্রবণ হানি গুরুতর হয়ে উঠতে পারে। এই আর্টিকেলে আমরা শ্রবণ হানি সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করব, এর কারণ, ধরণ, এবং চিকিৎসা পদ্ধতি নিয়ে।
শ্রবণ হানি কী?
শ্রবণ হানি হলো কান শোনার ক্ষমতা হ্রাস পাওয়ার সমস্যা। এটি বিভিন্ন মাত্রায় হতে পারে, যেমন হালকা, মাঝারি বা গুরুতর। শ্রবণ হানি এক কান বা দুই কানে হতে পারে এবং এর প্রভাব ব্যক্তি অনুসারে আলাদা হতে পারে।
শ্রবণ হানির ধরণ
শ্রবণ হানি তিন ধরনের হয়ে থাকে:
কন্ডাকটিভ শ্রবণ হানি (Conductive Hearing Loss):
এটি ঘটে যখন কান পেরিফেরি বা মধ্য কানে কোনো সমস্যার কারণে শব্দ সঠিকভাবে ভিতরের কানে পৌঁছাতে পারে না।
কারণ: কানের পর্দার ছিদ্র, কানে পানি বা মোম জমা হওয়া, সংক্রমণ, বা মধ্য কানে প্রদাহ।
চিকিৎসা: সাধারণত চিকিৎসা বা অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে চিকিৎসা করা যায়।
এটি ঘটে যখন কানের ভেতরের অংশ বা শ্রবণ নার্ভ ক্ষতিগ্রস্ত হয়, যা শব্দকে ব্রেনে পৌঁছাতে বাধা দেয়।
কারণ: বয়স, উচ্চশব্দে শোনা, ট্রমা, বা জেনেটিক কারণে এটি হতে পারে।
চিকিৎসা: শ্রবণ যন্ত্র বা কক্লিয়ার ইমপ্ল্যান্টের মাধ্যমে চিকিৎসা করা যেতে পারে।
মিক্সড শ্রবণ হানি (Mixed Hearing Loss):
এটি কন্ডাকটিভ এবং সেন্সোরিনিউরাল শ্রবণ হানির একটি মিশ্রণ, অর্থাৎ এক সঙ্গে মধ্য কানে এবং ভেতরের কানে সমস্যা হতে পারে।
চিকিৎসা: এ ধরনের শ্রবণ হানির জন্য চিকিৎসা বা শ্রবণ যন্ত্রের প্রয়োজন হতে পারে।
শ্রবণ হানির কারণ
শ্রবণ হানি হওয়ার প্রধান কারণগুলো হলো:
বয়স: বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে শ্রবণ ক্ষমতা কমে যেতে পারে, যা প্রেসবিকিউসিস নামে পরিচিত।
উচ্চশব্দে শোনা: দীর্ঘ সময় ধরে উচ্চশব্দে শোনা শ্রবণ হানি সৃষ্টি করতে পারে।
জেনেটিক কারণ: কিছু মানুষ জন্মগতভাবে শ্রবণ হানির ঝুঁকিতে থাকতে পারে।
ইনফেকশন বা আঘাত: কানে সংক্রমণ বা শারীরিক আঘাতও শ্রবণ হানির কারণ হতে পারে।
অন্য মেডিকেল পরিস্থিতি: ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, এবং কিছু ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া শ্রবণ হানি সৃষ্টি করতে পারে।
শ্রবণ হানির লক্ষণ
শ্রবণ হানির কিছু সাধারণ লক্ষণ:
কথাবার্তা পরিষ্কারভাবে না শোনা বা বুঝতে না পারা।
অধিকাংশ সময় মানুষের কাছ থেকে প্রশ্ন শুনতে বা বুঝতে সমস্যা হওয়া।
টেলিভিশনের বা রেডিওর ভলিউম বেশি বাড়িয়ে রাখা।
কানে শোঁ শোঁ বা গুঞ্জন শোনা।
সামাজিক অবস্থায় সমস্যা সৃষ্টি হওয়া বা একাকীত্ব অনুভব করা।
শ্রবণ হানির চিকিৎসা
শ্রবণ হানির জন্য বিভিন্ন চিকিৎসা পদ্ধতি রয়েছে:
শ্রবণ যন্ত্র: সেন্সোরিনিউরাল শ্রবণ হানি এবং মিক্সড শ্রবণ হানির জন্য শ্রবণ যন্ত্র ব্যবহার করা হয়।
কক্লিয়ার ইমপ্ল্যান্ট: গম্ভীর সেন্সোরিনিউরাল শ্রবণ হানির জন্য কক্লিয়ার ইমপ্ল্যান্ট একটি কার্যকরী পদ্ধতি।
অস্ত্রোপচার: কন্ডাকটিভ শ্রবণ হানির জন্য কখনো কখনো অস্ত্রোপচার প্রয়োজন হতে পারে।
শ্রবণ থেরাপি: অডিটরি প্রসেসিং ডিজঅর্ডারের জন্য শ্রবণ থেরাপি সহ অন্যান্য চিকিৎসা পদ্ধতি কার্যকর।
শ্রবণ হানি প্রতিরোধে সচেতনতা
শ্রবণ হানি থেকে রক্ষা পেতে কিছু সচেতনতা জরুরি:
উচ্চশব্দে থেকে দূরে থাকা: দীর্ঘ সময় ধরে উচ্চশব্দে শোনা শ্রবণ হানি সৃষ্টি করতে পারে, তাই সাউন্ড প্রটেকশন ব্যবহার করা উচিত।
নিয়মিত শ্রবণ পরীক্ষা করা: বিশেষ করে ৫০ বছরের পর শ্রবণ পরীক্ষা নিয়মিত করা উচিত।
স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন: ভালো খাদ্যাভ্যাস এবং নিয়মিত ব্যায়াম শ্রবণ হানির ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে।
শ্রবণ হানি একটি সাধারণ, কিন্তু গুরুতর সমস্যা হতে পারে, যা মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় প্রভাব ফেলে। এর কারণ জানা এবং সময়মতো চিকিৎসা গ্রহণ করার মাধ্যমে এই সমস্যা মোকাবিলা করা সম্ভব। শ্রবণ হানির যত্ন নিতে হলে প্রাথমিক অবস্থায় তার সঠিক নির্ণয় ও উপযুক্ত চিকিৎসা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।